উমরাহ্ কিভাবে করবেনঃ সকল মাসায়েল এবং নিয়ম একসাথে
উমরাহ্ হলো ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা নির্দিষ্ট স্থানে ইহরাম বাঁধা থেকে শুরু হয়ে বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ায় সায়ী, এবং শেষে মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
যারা মীকাতের বাইরের বাসিন্দা, তাদের মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। মক্কায় পৌঁছে প্রথমে বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করতে হবে। তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়।
এরপর সাফা পাহাড় থেকে শুরু করে সাফা-মারওয়ার মধ্য দিয়ে সায়ী সম্পন্ন করতে হবে। সায়ীর পর চুল মুণ্ডন বা আঙ্গুলের এক কড়া পরিমাণ চুল ছেঁটে ইহরাম মুক্ত হওয়া যায়। উমরাহ্কে সাধারণভাবে ছোট হজ্জ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
যাদের শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে, তাদের জীবনে একবার উমরাহ্ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। বারবার উমরাহ্ করা নফল ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। হাদীস শরীফে বারংবার উমরাহ্ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
উমরাহ্ এর ফরজ দুটি:
১. ইহরাম বাঁধা ও তালবিয়া পাঠ করা।
২. বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা।
উমরাহ্ এর ওয়াজিব দুটি:
১. সাফা ও মারওয়ার মধ্য দিয়ে সায়ী করা।
২. মাথা মুণ্ডন করা বা আঙ্গুলের এক কড়া পরিমাণ চুল কাটা।
উমরাহ্ পালনের মূল কাজগুলো হলো ইহরাম বাঁধা, তাওয়াফ করা, সায়ী করা এবং চুল কেটে বা মুণ্ডিয়ে ইহরাম মুক্ত হওয়া। এর ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পালন করলে উমরাহ্র ইবাদত সম্পন্ন হয়।
উমরাহ্ করার বিধান – ধাপে ধাপে সব নিয়ম
চলুন যেনে নেই উমরাহ্ আদায়ের সব নিয়ম এবং মাসায়েল ধাপে ধাপে, একে একে। উল্লেখ্য যে, এই মাসাআলা গুলো আমাদের শরিয়াহ বিষয়ক পরামর্শদাতা মুফতি হেদায়াতুল হক দামাত বারাকাতুহুমের ”কিভাবে উমরাহ্ করবেন” নামের সংক্ষিপ্ত বই থেকে সঙ্কলিত।
ধাপ ১ – ইহরাম বাধা – সুন্নত পদ্ধতি
আগেই বলেছি যারা মীকাতের বাইরের বাসিন্দা, তাদের মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। মীকাত কোন অঞ্চলকে বলা হয়?
মীকাত হলো বিশেষ নির্দিষ্ট স্থান যা বাইতুল্লাহ শরীফে যাওয়ার পথে হজ ও ওমরাকারীদের জন্য ইহরাম বাঁধার শর্ত হিসাবে নির্ধারিত। এই স্থানগুলোর বাইরে বসবাসকারী সকল মুসলমানের জন্য মীকাত অতিক্রম করার পূর্বে ইহরাম বাঁধা ওয়াজিব।
মীকাতের পাঁচটি স্থানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা হজযাত্রীদের জন্য ইহরাম বাঁধা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
মীকাতের প্রকারভেদ এবং ৫ টি অঞ্চলের নাম
মীকাতের নাম | লোকেশন | কারা ব্যবহার করেন এই মীকাত |
---|---|---|
যুল হুলাইফা (বীরে আলী) | মদীনা শরীফ থেকে প্রায় ১০ কি.মি. দূরে | মদীনা থেকে মক্কায় গমনকারী হজযাত্রীদের জন্য |
ইয়ালামলাম (সাদিয়া) | লোহিত সাগরের পাড়, মক্কার দক্ষিণে | দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকে আগতদের জন্য |
আল-জুহফা (রাবেগ) | মক্কার উত্তর পশ্চিমে লোহিত সাগরের পাড়ে | সিরিয়া, মিশর, তুর্কি থেকে আসা হজযাত্রীদের জন্য |
কারনুল মানাজিল (আসসায়লুল কাবীর) | মক্কার উত্তর পূর্বে, নাভাদ বা রিয়াদ দিক থেকে | বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান থেকে প্লেনে আসা হজযাত্রীদের জন্য |
যাতু ইরক (আয-যারীবাহ) | মক্কার উত্তর পূর্বে, ইরাকের দিক থেকে | ইরাক দিক থেকে আগত হজযাত্রীদের জন্য |
কারনুল মানাজিল (আসসায়লুল কাবীর) এটি হচ্ছে মক্কা শরীফ থেকে ত্রিশ পয়ত্রিশ মাইল উত্তর পূর্বে একটি পাহাড়। নাভাদ বা রিয়াদের দিক থেকে আগত হাজীদের জন্য মীকাত। মসজিদে হারাম থেকে ৭৮ কি. মি. দূরে। বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়া থেকে প্লেন যোগে হজ করতে গেলেও এই মীকাত অতিক্রম করে যেতে হয়। এবং এটাই আমাদের মীকাত।
মীকাত অতিক্রম করার সময় প্লেনে আপনাকে জানানো হবে। সাধারনত ডিরেক্ট ফ্লাইটের যাত্রীরা বাসা থেকেই এবং ট্রানজিট হলে মাঝখানের স্টপেজে ইহরাম পড়ে নেন।
মীকাতের আগেই ইহরাম বাধা জায়েজ। বরং ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজে জড়িত হবার আশঙ্কা না থাকলে এটাই উত্তম।
ইহরাম বাঁধার আগে কিছু সুন্নত কার্য পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইহরাম শুরু করার আগে শরীরের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, যেমন হাত-পায়ের নখ কাটা এবং শরীরের অবাঞ্চিত পশম পরিষ্কার করা সুন্নত।
যদি বিবাহিত থাকেন এবং স্ত্রীর সাথে সহবাসের সুযোগ থাকে, তাহলে সহবাস করাও মুস্তাহাব। এরপর ভালোভাবে গোসল করা উচিত। যদি গোসলের সুযোগ না থাকে, তবে ওযু করা প্রয়োজন।
এরপর সাধারণ কাপড় পরিবর্তন করে ইহরামের কাপড় পরতে হবে। ইহরামের জন্য সেলাই করা কোনো কাপড় পরিধান করা নিষেধ, তাই গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া বা সেলাই করা অন্য কোনো পোশাক খুলে ফেলতে হবে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এমন সুগন্ধি ব্যবহার করা যেতে পারে যার ঘ্রাণ থাকে কিন্তু কোনো রঙ বা দাগ থাকে না।
নারীদের জন্য বিশেষ কোনো ইহরামের কাপড়ের প্রয়োজন নেই, তারা তাদের স্বাভাবিক পোশাকেই থাকবে। তবে তারা এমনভাবে চেহারা ঢাকবে যেন পরপুরুষের কাছ থেকে পর্দা করা যায়, আবার কাপড় চেহারার সাথে লেপ্টে না থাকে। বাজারে পাওয়া যায় এমন ক্যাপ ব্যবহার করতে পারে, যা এই কাজে সহায়ক।
এরপর মাকরুহ সময় না হলে ইহরামের উদ্দেশ্যে দুই রাকাত নামাজ পড়া সুন্নত। প্রথম রাকাতে সুরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস (কুলহু আল্লাহ) পড়া সুন্নত। যদি না পারেন, তবে যেকোনো সুরা পড়তে পারেন।
নামাজ শেষে তাওবা ও ইসতেগফার করা উচিত এবং আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত।
ইহরামের নিয়ত ও তালবিয়া
নামাজ শেষে, পুরুষরা তাদের টুপি খুলে ফেলবে। নারীরা যদি অপবিত্র অবস্থায় থাকে, তবে তাদের নামাজ পড়তে হবে না। এরপর হজ বা উমরাহ্র নিয়ত করতে হবে।
যদি কেউ তামাত্তু করার জন্য উমরাহ্র নিয়ত করে, তবে এভাবে নিয়ত করবে:
اللهم إني أريدُ الْعُمْرَةَ فَيَسِرُهَا لِي وَتَقَبَّلْهَا مِنّي
“হে আল্লাহ, আমি উমরাহ্ আদায়ের নিয়ত করেছি। আপনি তা আমার জন্য সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।”
যদি শুধু উমরাহ্ করতে চান, তাহলে এভাবেও নিয়ত করা যায়। ইফরাদ করার জন্য শুধু হজের নিয়ত করতে হবে:
اللهم اني أُرِيدُ الْحَجَّ فَيَسْرُهُ لِي وَتَقَبَّلْهُ مِني
“হে আল্লাহ, আমি হজ আদায়ের নিয়ত করেছি। আপনি তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।”
কিরান করার জন্য, উভয়ের নিয়ত এভাবে করা হবে:
اللهم إني أريدُ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ فَيَسِرْهُمَا لِي وَتَقَبَّلْهُمَا مِنِّي
“হে আল্লাহ, আমি হজ ও উমরাহ্ আদায়ের নিয়ত করেছি। আপনি তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।”
তালবিয়া পাঠ
নিয়ত করা পর তালবিয়া পাঠ করা শুরু করতে হবে। পুরুষদের ক্ষেত্রে উচ্চ আওয়াজে এবং নারীদের ক্ষেত্রে আস্তে আওয়াজে তিনবার তালবিয়া পাঠ করা সুন্নত:
لَبَّيْكَ اللهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ
“আমি হাজির (উপস্থিত), হে আল্লাহ, আমি (আপনার দরবারে) হাজির! আমি হাজির, আপনার কোন অংশীদার নেই, আমি (আপনার দরবারে) হাজির। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নিয়ামত আপনারই, এবং সাম্রাজ্যও আপনার, আপনার কোনো শরিক নেই।”
বিশেষ কিছু মাসআলাঃ
- নিয়তের জন্য আরবি বাক্যগুলি মুখে উচ্চারণ করা আবশ্যক নয়। তবে অন্তরে সঠিক নিয়ত থাকা অবশ্যই জরুরি। নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
- যারা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মদীনা শরীফে যাবেন, তাদের জন্য দেশে থেকেই ইহরাম বাধ্যতামূলক নয়। মদীনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে যুল হুলাইফা বা বীরে আলী মীকাত থেকে ইহরাম ধারণ করতে হবে।
- তালবিয়া শেখার জন্য চেষ্টা করা উচিত, কারণ বাংলা ভাষায় আরবি উচ্চারণ সঠিকভাবে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ইহরামের জন্য কমপক্ষে একবার তালবিয়া বা তার স্থলাভিষিক্ত অন্য কোনো যিকির মুখে উচ্চারণ করা শর্ত, এবং এটি তিনবার পড়া সুন্নত। তবে তালবিয়া মনে মনে পড়া যথেষ্ট নয়; এটি অবশ্যই মুখে উচ্চারণ করতে হবে।
- যদিও নিজের মাতৃভাষায় তালবিয়া পড়া বৈধ, তবে আরবীতে পড়া উত্তম। ইহরাম শুরু করার পর যত বেশি সম্ভব তালবিয়া পড়তে হবে, এবং প্রতিবার তিনবার করে পড়া উত্তম। তালবিয়া পড়ার সময় সমস্বরে পড়া উচিত নয়; প্রত্যেককে নিজের মতো পড়তে হবে।
- নতুন যেকোনো পরিস্থিতিতে তালবিয়া পড়া মুস্তাহাব। যেমন, কোনো উঁচু জায়গায় উঠার সময় তাকবীরের সঙ্গে তালবিয়া বলা উত্তম। ওমরাহর সময় তাওয়াফ শুরু করা পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে থাকুন। পুরুষরা তালবিয়া উচ্চস্বরে বলবে, কিন্তু এতো জোরে নয় যে নিজের বা অন্যের কষ্ট হয়; নারীরা নিচু স্বরে পড়বে।
মক্কা পৌঁছানোর পরে করনীয়
মক্কা শরীফে পৌঁছে প্রথমেই নিজের মালপত্র হোটেলে রেখে দিন। যদি নামাজের সময় হয়, তাহলে নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন।
ক্লান্তি দূর হলে এবং বিশ্রামের পর, সবাই পরামর্শ করে উমরাহ্ করার জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করুন।
- মসজিদে হারামে যাওয়ার আগে আবার উমরাহ্র নিয়মগুলো ভালোভাবে দেখে নিন।
- অজু করে নিন।
মসজিদে হারামে প্রবেশের নিয়ম
সুন্নাত মোতাবেক দোয়া পড়ে, ইতিকাফের নিয়তে, ডান পা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করুন।
বাইতুল্লাহ শরীফ দেখার পর প্রথমে তিনবার এ দোয়া পড়ুন:
اللَّهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَلِلّهِ الْحَمْدُ
(উচ্চারণ: আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহিল হামদ)।
এরপর বলুন:
اللهم انتَ السَّلَامُ وَمِنْكَ السَّلَامُ فَحْيِنَا رَبَّنَا بِالسَّلَامِ
(উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আন্তাস সালাম, ওয়া মিনকাস সালাম, ফাহইনা রাব্বানা বিসসালাম)।অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি হলেন শান্তি, এবং শান্তি আপনার থেকেই। আমাদের জীবন শান্তিময় করে দিন।
তারপর দোয়া করুন:
اللَّهُمَّ زِدْ هَذَا الْبَيْتَ تَشْرِيفًا وَتَعْظِيمًا وَتَكْرِيمًا وَمَهَابَةً وَزِدْ مَنْ شَرِّفَهُ وَكَرَّمَهُ مِمَّنْ حَجَّهُ وَاعْتَمَرَهُ تَشْرِيفًا وَتَعْظِيمًا وَتَكْرِيمًا وَبِرًّا
(উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা যিদ হাযাল বাইত তাশরীফান ওয়া তাআযীমান ওয়া তাকরীমান ওয়া মাহাবাতান, ওয়া যিদ মান শররফাহু ওয়া কাররামাহু মিম্মান হাজ্জাহু ওয়া এতামারাহু তাশরীফান ওয়া তাআযীমান ওয়া তাকরীমান ওয়া বিররান)।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি এই ঘরের সম্মান, মর্যাদা, এবং প্রভাব বাড়িয়ে দিন। যারা এই ঘরকে সম্মান করে এবং হজ ও উমরাহ্ পালন করে, তাদের মর্যাদা ও কল্যাণ বাড়িয়ে দিন।
- এই সময় দাঁড়িয়ে মনভরে দোয়া করুন, কারণ এটি দোয়া কবুলের বিশেষ মুহূর্ত।
- এরপর মাতাফে নেমে প্রথমে দেখে নিন, হাজারে আসওয়াদ বা সবুজ বাতি কোন দিকে রয়েছে। মনে রাখবেন, এই মাতাফে অনেক নবীগণের কবর রয়েছে, তাই অত্যন্ত আদব ও সম্মানের সঙ্গে চলুন।
- পুরুষদের জন্য ইযতিবা করা সুন্নত। অর্থাৎ, ডান কাঁধে থাকা ইহরামের চাদর নামিয়ে ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধে রেখে দিন।
- বাইতুল্লাহ শরীফের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে হাজারে আসওয়াদ স্থাপিত আছে, এবং তার পেছনে সবুজ বাতি জ্বালানো রয়েছে। হাজারে আসওয়াদকে আপনার ডানে রেখে, তার থেকে একটু বায়ে দাঁড়ান। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রথমে বাইতুল্লাহ শরীফের তাওয়াফের নিয়ত করুন। নিয়ত করা আবশ্যক, তবে মুখে উচ্চারণ করা আবশ্যক নয়। যদি মুখে বলার ইচ্ছা হয়, তবে এভাবে বলতে পারেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أُرِيدُ طَوَافَ بَيْتِكَ الْحَرَامِ سَبْعَةَ أَشْوَاطٍ لِلَّهِ تَعَالَى فَيَسِّرْهُ لِي وَتَقَبَّلْهُ مِنِّي
(উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদু তাওয়াফা বাইতিকাল হারাম সাব’আত আশওয়াতিল্লিল্লাহি তা’আলা ফায়াস্সিরহু লী ওয়া তাক্বাব্বালহু মিন্নী)।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য, আপনার পবিত্র ঘরের সাত চক্কর তাওয়াফ করার নিয়ত করছি। আপনি তা আমার জন্য সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করে নিন।
শুরু করুন তাওয়াফ, সুন্নাহ পদ্ধতিতে
ধাপ ১ – এবার হাজারে আসওয়াদের সোজাসুজি গিয়ে তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ান। তাকবীরে তাহরীমার মতো উভয় হাত উঠিয়ে اللهُ أَكْبَرُ বলুন।
ধাপ ২ – ইসতিলাম করুন। সুন্নত হলো, যদি সম্ভব হয়, কাউকে কষ্ট না দিয়ে, হাজারে আসওয়াদের দুই পাশে হাত রেখে, চেহারা তার মাঝখানে রেখে চুম্বন করা। চুম্বন করার সময় আওয়াজ করা নিষিদ্ধ। শুধু ঠোঁট দুটি হাজারে আসওয়াদের ওপর রেখে দিন।
যদি ভীড়ের কারণে চুম্বন করা সম্ভব না হয়, তাহলে দূর থেকে ইশারা করুন। ইশারার পদ্ধতি হলো, উভয় হাত হাজারে আসওয়াদের দিকে প্রসারিত করুন এবং হাতের তালু এমনভাবে রাখুন যেন তার পেট হাজারে আসওয়াদের দিকে থাকে। ইশারার সময় এই দোয়া পড়ুন:
اللهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللهِ
(উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ)।
তারপর নিজ হাতে চুম্বন করুন।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা হল, তাওয়াফের সময় এবং ইহরাম অবস্থায়, বিশেষ করে সুযোগ থাকলেও হাজারে আসওয়াদে সরাসরি চুম্বন করা উচিত নয়। ইসতিলাম (দূর থেকে ইশারা) করে তাওয়াফ করুন, কারণ হাজারে আসওয়াদে সাধারণত সুগন্ধি মাখানো থাকে। ইহরাম অবস্থায় সুগন্ধি লাগানো নিষেধ। তাই ইহরাম অবস্থায় হাত লাগালে বা চুমু খেলে উল্টা দম (প্রায়শ্চিত্ত) ওয়াজিব হতে পারে।
ধাপ ৩ –ইসতিলাম করে ডানে ফিরে, বাইতুল্লাহ শরীফকে বামদিকে রেখে তাওয়াফ শুরু করুন।
পুরুষরা তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল (সৈনিকদের মতো কাঁধ দুলিয়ে দ্রুতগতিতে চলা) করবেন।তাওয়াফের সময় যেকোনো দোয়া পড়তে পারেন, তবে বিশেষ কোনো দোয়া পড়া বাধ্যতামূলক নয়।উঁচু আওয়াজে বা সম্মিলিত কণ্ঠে দোয়া করা ঠিক নয়, এতে অন্যদের একাগ্রতা নষ্ট হতে পারে।
ধাপ ৪ – তাওয়াফ করার সময় হাতীম (কাবার বাইরের অংশ) দিয়ে ঘুরে রুকনে ইয়ামানী পর্যন্ত আসুন। রুকনে ইয়ামানীতে হাত লাগানো সুন্নত, তবে তা সম্ভব না হলে ইসতিলামের মতো ইশারা করবেন না, কারণ এটি ভুল।
উল্লেখ্য, হাজারে আসওয়াদের মতো রুকনে ইয়ামানীতেও সুগন্ধি মাখানো থাকে। তাই ইহরাম অবস্থায় এতে হাত লাগাবেন না। তবে ইহরাম ছাড়া নফল তাওয়াফের সময় এতে হাত লাগাতে পারেন।
রুকনে ইয়ামানী থেকে হাজারে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে নিচু আওয়াজে এই দোয়া পড়ুন:
رَبَّنَا اتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণ: রাব্বানা আতিনা ফি দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াক্বিনা আযাবান-নার।
অর্থ: “হে আমাদের প্রভু, আপনি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান করুন, আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন, এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন।”
এরপর হাজারে আসওয়াদ পর্যন্ত পৌঁছে তাওয়াফের এক চক্কর পূর্ণ করুন। এ পর্যন্ত পৌঁছলে আপনার এক চক্কর পূর্ণ হল।
তাওয়াফের সাত চক্কর শেষ করুন এভাবেই
- প্রতিবার হাজারে আসওয়াদ বরাবর পৌঁছে ইসতিলাম করে পরবর্তী চক্কর শুরু করুন।
- এভাবে সাত চক্কর পূর্ণ করুন। সাত চক্কর পূর্ণ হলে আপনার তাওয়াফ শেষ হবে।
- তাওয়াফের পুরো সময় ওযু থাকা শর্ত।
- হাতের আঙ্গুলে বা তাসবীহের মাধ্যমে তাওয়াফের চক্কর গণনা করা নিষেধ নেই।
তাওয়াফ শেষে করণীয়
তাওয়াফ শেষে পুরুষরা ইহরামের চাদর ঠিক করে নিন। ইযতিবা (ডান কাঁধে চাদর ফেলা) আর করার প্রয়োজন নেই। অনেকে সায়ীর সময়েও ইযতিবা করেন, যা ভুল।
- অনেক ফুকাহায়ে কেরামের মতে, তাওয়াফ শেষে প্রথমে তাওয়াফের দুই রাকাত ওয়াজিব নামায আদায় করা উচিত, তারপর যমযমের পানি পান করা, তারপর মুলতাযামে গিয়ে দুআ করা।
- আবার অনেকের মতে, তাওয়াফ শেষ করে প্রথমে মুলতাযামে দুআ করবেন, তারপর নামায আদায় করবেন এবং তারপর যমযম পান করে সায়ীর জন্য রওয়ানা করবেন।
বর্তমান পরিস্থিতি এবং করনীয়
আল্লামা শামী রহ. বলেন, দ্বিতীয় অভিমতটি সহজ ও উত্তম। বর্তমানের ভিড়ের পরিস্থিতিতে এটি সহজতর এবং আমল করে আসা হয়েছে।
বর্তমানে মাতাফে ভিড় বেশি থাকায়, বারবার আসা-যাওয়া করা নিজের জন্য কঠিন এবং অন্যদের জন্য কষ্টদায়ক। তাই সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত।
সুতরাং তাওয়াফ শেষে, সুযোগ থাকলে প্রথমে মুলতাযামে যান, তারপর মাকামে ইবরাহীমে গিয়ে নামায আদায় করুন, এবং তারপর যমযম পান করুন।
১। মুলতাযামে দুআ
- তাওয়াফ শেষ করে, যদি ভিড় কম থাকে এবং কাউকে কষ্ট না দিয়ে সম্ভব হয়, মুলতাযামে গিয়ে দুআ করুন।
- মুলতাযাম হলো, হাজারে আসওয়াদ এবং কা’বা শরীফের দরজার মধ্যবর্তী স্থান। এটি দুআ কবুলের একটি বিশেষ স্থান।
২। মাকামে ইবরাহীমে নামায আদায়
- তাওয়াফের সাত চক্কর শেষ হলে, নামাযের নিষিদ্ধ বা মাকরুহ সময় না থাকলে, মাকামে ইবরাহীমের পেছনে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত তাওয়াফের ওয়াজিব নামায আদায় করুন।
- যদি সেখানে জায়গা না পান, তাহলে হারামের যেকোনো স্থানে এই নামায আদায় করা যাবে।
- প্রথম রাকাতে সুরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস পড়া মুস্তাহাব।
৩। যমযমের পানি পান
- নামাযের পর, পেট ভরে যমযমের পানি পান করুন। এটি দুআ কবুলের সময়।
- যমযম পান করার সময় এই দুআ পড়ুন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَرِزْقًا وَاسِعًا وَشِفَاءٌ مِنْ كُلِّ دَاءٍ
(উচ্চারণ: “আল্লাহ! আমি তোমার কাছে উপকারী জ্ঞান, প্রশস্ত রিজিক এবং সকল রোগ থেকে আরোগ্য প্রার্থনা করছি।”)
শুরু হচ্ছে সাফা মারওয়া সায়ী…
সাফা ও মারওয়া’র সায়ী তাওয়াফের পর ওয়াজিব।
সায়ী শুরু করার আগে, পুনরায় বাইতুল্লাহমুখী হয়ে একবার ইসতিলাম করা মুস্তাহাব। এরপর, সম্ভব হলে বাবুস সাফা দিয়ে সাফা পাহাড়ে যাওয়া সুন্নত।
বাইতুল্লাহর পূর্ব দক্ষিণ কোণে সাফা পাহাড়ের অবস্থান। বর্তমানে সায়ী করার জন্য বেশ কয়েকটি ফ্লোর আছে, আপনি সুবিধামতো যেকোনো ফ্লোরে সায়ী করতে পারেন।
বর্তমানে সাফা পাহাড়ে উঠার সুযোগ নেই, তাই সাফা পাহাড়ের পাদদেশে এমন স্থানে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন, যেখান থেকে বাইতুল্লাহ দেখা যায়।
সায়ীর নিয়ত এবং দুআ
সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে এই আয়াত পড়ুন:
أَبْدَا بِمَا بَدَا اللهُ تَعَالَى بِهِ إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ
(উচ্চারণ: “আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন, আমিও তাই দিয়ে শুরু করছি। নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন।”)
তারপর, কা’বার দিকে মুখ করে দাঁড়ান এবং সায়ীর নিয়ত করুন। নিয়ত এভাবে করতে পারেন:
হে আল্লাহ! আমি সাফা ও মারওয়ার সায়ী করার নিয়ত করছি। আপনি তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন।
নিয়ত শেষে, দুআ করার মতো করে হাত উঠান, কিন্তু তাকবীরে তাহরীমার মতো নয়, এবং বাইতুল্লাহর দিকে কোনো ইশারা করবেন না। তারপর শুরু করুন দুয়া। দুয়া করে আপনার সায়ী শুরু হবে।
ধাপ ১ – সাফায় তিনবার দুআ
- তিনবার স্বাভাবিক উঁচু আওয়াজে বলুন:
اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَللهِ الْحَمْدُ- তারপর তিনবার এই দুআ পড়ুন:
لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ- এরপর বলুন:
سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ للهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ
এরপর আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে, দুরুদ শরীফ পড়ে, আল্লাহর কাছে মিনতির সঙ্গে দুআ করুন। এটি দুআ কবুলের বিশেষ স্থান ও সময়।
ধাপ ২ – সাফা থেকে মারওয়ার দিকে যাত্রা
- মনে মনে দুআ করতে করতে সাফা থেকে মারওয়ার দিকে রওয়ানা করুন।
- কিছু দূর গেলে সবুজ বাতি দেখতে পাবেন। যেখানে হাজেরা আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৌড়েছিলেন, ঠিক সেই জায়গাটাতে উপরে সবুজ বাতি দিয়ে মার্ক করা আছে।
- পুরুষরা এই সবুজ বাতির জায়গা মধ্যম গতিতে দৌড়ে অতিক্রম করবেন, আর নারীরা স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন।
দৌড়ানোর সময়ের দুআ
সবুজ বাতির জায়গা অতিক্রম করার সময় সম্ভব হলে এই দুআ পড়ুন:
رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْاَعَةُ الأَكْرَمُ
ধাপ ৩ – মারওয়াতে পৌঁছে দুআ
- মারওয়াতে পৌঁছে কেবলামুখি হয়ে সেইভাবে দুআ করুন, যেভাবে সাফায় করেছিলেন।
- এটি-ও দুআ কবুলের বিশেষ স্থান।
এভাবে সায়ীর প্রথম চক্কর শেষ হবে। এরপর মারওয়া থেকে সাফার দিকে ফিরে আসবেন। সবুজ বাতির জায়গায় পৌঁছে পুরুষরা আবারও মধ্যম গতিতে দৌড়ে অতিক্রম করবেন।
এভাবে সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাত চক্কর পূর্ণ করবেন। প্রতিবার সাফা ও মারওয়াতে পৌঁছে কেবলামুখি হয়ে হাত তুলে দুআ করবেন।
কিছু মাসআলা
১. সায়ী করার সময় ওযু থাকা শর্ত নয়, তবে ওযু অবস্থায় সায়ী করা উত্তম।
২. হায়েয ও নেফাসগ্রস্ত নারীরাও সায়ী করতে পারবেন।
৩. সায়ী শেষ করার পর দুই রাকাত নামায আদায় করা মুস্তাহাব।
৪. এই নামায মসজিদে হারামের যেকোনো স্থানে আদায় করা যাবে, তবে মারওয়াতে নয়।
৫. সায়ী শেষ হলে পুরুষদের জন্য মাথা মুণ্ডানো (হলক) উত্তম।
৬. মুণ্ডানো না চাইলে মাথার চারপাশ থেকে আঙ্গুলের এক কড়া পরিমাণ চুল কাটতে হবে।
৭. নারীদের জন্য মাথা মুণ্ডানো জায়েয নয়।
৮. নারীরা তাদের চুলের অগ্রভাগ একত্র করে আঙ্গুলের এক কড়া পরিমাণ কেটে ফেলবে।
৯. হলক (মাথা মুণ্ডানো) বা কসর (চুল কাটা) করার পর ওমরার কাজ শেষ।
১০. এখন আপনি হালাল। ইহরামের কাপড় খুলে স্বাভাবিক পোষাক পরিধান করে নিন।
১১. পুনরায় হজ বা ওমরার ইহরাম করা পর্যন্ত ইহরামের কোনো বিধি নিষেধ আপনার জন্য প্রযোজ্য নয়।
১২. যিনি শুধু ওমরার ইহরাম করেছেন, হলক বা কসরের মাধ্যমে তিনি ইহরাম থেকে বেরিয়ে যাবেন।
উপসংহার
আশা করি উমরাহ্ নিয়ে একটা ডিটেইল দিক নির্দেশনা আপনাদের দিতে পেরেছি, আলহামদুলিল্লাহ্। আরও বেশ কিছু মাসআলা আছে, যেগুলো আমরা অন্য কয়েকটি পোস্টে উল্লেখ করব যেন সেটা পড়তে আপনাদের জন্য সুবিধা হয়।
যদি ইহরাম ও তালবিয়া সংক্রান্ত মাসায়েল জানতে চান, ঘুরে আসুন এই পোস্ট থেকে।