ইহরাম ও তালবিয়া সংক্রান্ত মাসায়েলঃ যা জানা জরুরি
ইহরাম অবস্থায় ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান পালন করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইহরাম গ্রহণের সময় এবং অবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ম রয়েছে যা মুসলমানদের জন্য জানা আবশ্যক।
এই পোস্টে আমরা ইহরামের কাপড়, খাদ্য গ্রহণের বিধি, পশু জবাই সংক্রান্ত মাসআলা, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা নিয়ে আলোচনা করব।
ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো মেনে চললে আমরা আমাদের ইবাদতকে আরো নিখুঁত ও সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হব।
ইহরাম ও তালবিয়া সংক্রান্ত মাসায়েল
মাসআলা | বিস্তারিত |
---|---|
ইহরামের সংজ্ঞা | ইহরাম মানে হারাম করা। শরীয়তের পরিভাষায়, হজ বা ওমরার নিয়তে তালবিয়া বা অন্য কোনো যিকির পাঠ করার মাধ্যমে বিশেষ কিছু কাজ থেকে বিরত থাকার শর্তের মধ্যে প্রবেশ করাই ইহরাম। |
ইহরাম ধরা নিয়ে সমস্যা | অনেক সময় এয়ারপোর্টে দেরি বা ফ্লাইটের সমস্যার কারণে ইহরাম অবস্থায় থাকাটা কষ্টকর হয়। এজন্য ইহরামের চাদর পরে নিন, কিন্তু নিয়ত বা তালবিয়া পড়বেন না। প্লেনে বসে সুবিধামতো সময়ে নিয়ত ও তালবিয়া পড়ুন, তবে মীকাত অতিক্রমের আগে ইহরাম শুরু করবেন। |
ইহরামের আগে নামাজ | ইহরাম শুরু করার আগে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। যদি সুযোগ না হয়, নামাজ ছাড়া ইহরাম শুরু করতে পারবেন। |
ফরয নামাজের পর ইহরাম | ইহরাম শুরু করতে চাইলে ফরয নামাজের পরও করা যাবে। মাকরুহ সময় না হলে আলাদা দুই রাকাত নামাজ আদায় করাই উত্তম। |
ইহরামের শর্ত | হজ বা ওমরার নিয়ত করা ও কমপক্ষে একবার তালবিয়া বা তার বিকল্প কোনো যিকির পড়া ফরয। কেবল নিয়ত করা যথেষ্ট নয়; পড়তে না পারলে অন্যের সাহায্য নিতে পারেন। |
তালবিয়া পড়ার সুন্নত | ইহরাম শুরু করার পর অধিক পরিমাণে তালবিয়া পড়া সুন্নত, বিশেষত প্রতিটি নতুন অবস্থায়। |
অজ্ঞান অবস্থায় ইহরাম | কেউ যদি অজ্ঞান থাকে এবং তার পক্ষ থেকে কেউ ইহরামের নিয়ত করে তালবিয়া পড়ে, তাহলে তার ইহরাম শুদ্ধ হবে এবং তাকে মুহরিম গণ্য করা হবে। |
তালবিয়ার উচ্চারণ | পুরুষরা জোরে তালবিয়া পড়বে, নারীরা নিচু স্বরে পড়বে। |
লোকসমাগমে তালবিয়া | শহরের ভেতরে বা জনসমাগমে তালবিয়া নিচু স্বরে পড়া উচিত। |
তালবিয়া একসঙ্গে তিনবার | প্রতিবার তালবিয়া পড়ার সময় একসঙ্গে তিনবার পড়া উত্তম। |
জেদ্দায় পৌঁছানোর আগে ইহরাম | বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান থেকে আসা হাজীদের জন্য মীকাত অতিক্রমের আগেই ইহরাম বাঁধা আবশ্যক। যদি মীকাত পার হয়ে যায়, তবে দম দিতে হবে। |
মক্কায় ইহরাম ধরা | মক্কায় অবস্থানরত ব্যক্তি মসজিদে হারাম থেকে ইহরাম শুরু না করলেও হবে। তবে মসজিদে হারাম থেকে শুরু করা উত্তম। |
ইহরাম বাঁধার নিয়ত | কেউ যদি ওমরা সম্পন্ন করতে না পারে, তবে ইহরাম বাঁধার সময় সে এভাবে নিয়ত করতে পারে যে, যদি কোনো কারণে বাধাপ্রাপ্ত হই, তাহলে আমি হালাল হয়ে যাব। এতে তার ওপর কোনো দম ওয়াজিব হবে না। |
ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমুহ এবং আরও কিছু জরুরি বিষয়
ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজগুলো
নিষিদ্ধ কাজ | বিস্তারিত |
---|---|
সুগন্ধি ব্যবহার | ইহরাম অবস্থায় পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য শরীরে বা পোশাকে সুগন্ধি ব্যবহার নিষেধ। |
সেলাই করা পোশাক | ইহরাম অবস্থায় পুরুষের জন্য দেহের আকার অনুযায়ী সেলাই করা পোশাক পরা নিষেধ। |
মাথা ও চেহারা ঢেকে রাখা | পুরুষের জন্য মাথা ও চেহারা ঢেকে রাখা নিষেধ। নারীদের জন্য চেহারার পর্দা ফরয, তবে চেহারার সঙ্গে কাপড় লাগানো নিষেধ। |
চুল ও নখ কাটা | ইহরাম অবস্থায় চুল কাটা বা তুলা এবং নখ কাটা নিষেধ। |
স্ত্রী সহবাস | ইহরাম অবস্থায় স্ত্রী সহবাস ও এ সম্পর্কিত আলোচনা নিষেধ। |
প্রাণী শিকার | ইহরাম অবস্থায় স্থল প্রাণী শিকার করা নিষেধ। |
তেল ব্যবহার | সরিষার তেল, নারিকেল তেল, বা কোনো তেল পুরো শরীরে ব্যবহার করলে দম ওয়াজিব হবে, কম হলে সদকা। |
সুগন্ধি সাবান ও শ্যাম্পু | সুগন্ধিযুক্ত সাবান, শ্যাম্পু ব্যবহার করা নিষেধ। ময়লা দূর করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে তা মাকরুহ। |
মেহেদী ব্যবহার | ইহরাম অবস্থায় মেহেদী ব্যবহার করা নিষেধ। |
গোসল | ইহরাম অবস্থায় গোসল করা জায়েজ, তবে শরীরের ময়লা দূর করা মাকরুহ। |
সীটবেল্ট ও বেল্ট | টাকা-পয়সা রাখার জন্য কোমরে বেল্ট ও সীটবেল্ট ব্যবহার করা জায়েজ। |
মুলতাযান স্পর্শ করা | ইহরাম অবস্থায় মুলতাযান স্পর্শ করা নিষেধ, কারণ সেখানে সুগন্ধি থাকে। |
ভিক্স/বাম ব্যবহার | ভিক্স বা বাম ব্যবহার করা নিষেধ, কারণ তাতে কর্পূর রয়েছে। |
পায়ের উঁচু হাড় ঢাকা | ইহরাম অবস্থায় এমন জুতা পরা যাবে না যা পায়ের উঁচু হাড় ঢেকে দেয়। |
মোজা পরা | ইহরাম অবস্থায় মোজা পরা নিষেধ। |
শীতের কাপড় | পুরুষরা শীতে মোটা চাদর বা তোয়ালে ব্যবহার করতে পারবে, তবে মাথা ও মুখ ঢাকতে পারবে না। |
ডাক্তারি নির্দেশে পট্টি | গলায় পট্টি ব্যবহার করা ডাক্তারি পরামর্শে জায়েজ। |
ইহরাম বাঁধার সময় বেহুশ | কেউ ইহরাম বাঁধার সময় বেহুশ হলে তার সঙ্গী তার পক্ষ থেকে নিয়ত ও তালবিয়া পড়লে ইহরাম শুদ্ধ হবে। |
ইহরামের চাদর লাগেজে রাখা | কেউ যদি ইহরামের চাদর লাগেজে দিয়ে দেয় এবং স্বাভাবিক পোশাক পরে মীকাত পার হয়, তবে তাকে সদকা দিতে হবে। |
নারীদের ইহরাম পোশাক | নারীরা কামিজ, সালোয়ার, মোজা, অলংকার পরতে পারবে, তবে সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখা জরুরি। |
বিবাহ ও আকদ | ইহরাম অবস্থায় বিবাহ বা আকদ করা জায়েজ, তবে সহবাস করা নিষেধ। |
ইঞ্জেকশন ও রক্তদান | ইহরাম অবস্থায় ইঞ্জেকশন নেওয়া বা রক্ত দেওয়া-নেওয়া জায়েজ। |
চশমা পরা | ইহরাম অবস্থায় চশমা পরা জায়েজ। |
ইহরামের তালবিয়া বাদ | কেউ যদি ইহরামের নিয়ত করে তালবিয়া না পড়ে, তবে তার ইহরাম শুদ্ধ হবে না এবং তাকে দম দিতে হবে। |
ফুলের ঘ্রাণ নেওয়া | ইহরাম অবস্থায় ফুল বা সুগন্ধি জিনিসের ঘ্রাণ নেওয়া মাকরুহ, তবে দম দিতে হবে না। |
সুগন্ধিযুক্ত খাবার | সুগন্ধিযুক্ত খাবার খাওয়া ইহরাম অবস্থায় জায়েজ। |
সুগন্ধিযুক্ত পানীয় | সুগন্ধিযুক্ত পানীয় ইহরাম অবস্থায় পান করা যাবে না। |
সুগন্ধি মাখানো বিছানা | সুগন্ধিযুক্ত বিছানায় ইহরাম অবস্থায় শোয়া নিষেধ। |
মৃত্যুর সময় ইহরাম | ইহরাম অবস্থায় কেউ মারা গেলে, তাকে সাধারণ কাফন-দাফনের মতোই দাফন করা হবে। |
ইহরামের কাপড় সংক্রান্ত মাসআলা
- ইহরাম অবস্থায় দুটি চাদর ব্যবহার করা সুন্নত। একটি চাদরও যথেষ্ট, তবে সতর ঢাকা শর্ত।
- ইহরাম অবস্থায় দুইয়ের অধিক সেলাইবিহীন কাপড় পরা জায়েয।
- সতর খুলে যাওয়ার আশংকা থাকলে ইহরামের চাদরের নিচের অংশে লুঙ্গির মতো সেলাই করা জায়েয। তবে বিনা প্রয়োজনে সেলাই করা জায়েয নয়।
- পুরুষদের জন্য ইহরামের কাপড় সাদা হওয়া উত্তম। তবে অন্য রংয়ের কাপড়ও জায়েয।
- ওমরা শেষ হলে ইহরামের কাপড় যেকোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে, এমনকি কাফন হিসেবে ব্যবহারেরও অনুমতি রয়েছে।
- ইহরাম অবস্থায় চাদর দ্বারা চেহারা বা মাথা ঢাকা নিষিদ্ধ, তবে পা ঢাকা নিষিদ্ধ নয়।
- ইহরাম অবস্থায় ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করা জায়েয, কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে ইহরাম অবস্থায় কাপড় পরিবর্তন করেছেন।
- ছাতা, ব্যাগ, বেল্ট ইত্যাদি ইহরাম অবস্থায় ব্যবহার করা জায়েয, এমনকি ইহরামের চাদরে পকেট লাগানোও জায়েয।
- ইহরাম অবস্থায় ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে পরিধান করা জায়েয।
ইহরাম অবস্থায় খাদ্য ও পশু জবাই সংক্রান্ত মাসআলা
- ইহরাম অবস্থায় মুরগী জবাই করা এবং খাওয়া জায়েয, এতে কোনো দম বা জরিমানা নেই।
- গৃহপালিত প্রাণী যেমন গরু, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা, ছাগল, হাঁস, মুরগী ইত্যাদি জবাই ও খাওয়া জায়েয।
- ক্ষতিকর প্রাণী যেমন সাঁপ, বিচ্ছু, মশা, মাছি, এবং হিংস্র প্রাণী যেমন বাঘ, সিংহ ইত্যাদি হত্যা করা জায়েয।
- মশা, পিঁপড়া মারা জায়েয। তবে যে পিঁপড়া কামড় দেয় না, তা মারা জায়েয নয়।
ইবাদত ও মীকাত সংক্রান্ত মাসআলা
- মীকাত অতিক্রম করার সময় ইহরাম বাধ্যতামূলক, তবে বিনা ওযরে হারামের বাইরে যাওয়া উচিত নয়।
- ইহরাম অবস্থায় নারীদের জন্য নিকাব পরিধান করা নিষিদ্ধ, তবে পর্দা করা ফরয।
- নারীদের জন্য যেকোনো রংয়ের পোশাক ইহরাম অবস্থায় পরিধান করা জায়েয, তবে পর্দা রক্ষা করা আবশ্যক।
- ইহরাম অবস্থায় হায়েযগ্রস্ত নারীর জন্য ইহরাম শুরু করা নিষিদ্ধ নয়, তবে পবিত্র হওয়ার পর তাওয়াফ করতে হবে।
- ইহরাম অবস্থায় আংটি পরিধান করা জায়েয, তবে না পরা উত্তম।
অন্যান্য মাসআলা
- ইহরাম অবস্থায় দাঁত খিলাল করা, মিসওয়াক করা এবং দাঁত ফেলা জায়েয।
- শরীর থেকে রক্ত বের হলে কোনো দম বা সদকা ওয়াজিব হবে না।
- ইহরাম অবস্থায় চেহারা বা মাথা ছাড়া শরীরের অন্য অংশে ব্যান্ডেজ বা প্লাস্টার করা জায়েয।