উমরাহর ইতিহাস: একটি বিস্তারিত পর্যালোচনা
উমরাহ ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ একটি ইবাদত, যা মুসলমানদের জন্য একটি গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। উমরাহ পালন করা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি মাধ্যম, যেখানে মুসলমানরা পবিত্র কাবা শরীফের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রকাশ করেন।
এটি কেবল একটি ধর্মীয় কর্তব্য নয়, বরং এটি মুসলিমদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে তারা নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ পান।
উমরাহ পালন করা মুসলমানদের জন্য এক নতুন আত্মার উদ্দীপনা নিয়ে আসে, যা তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে।
উমরাহের শাব্দিক অর্থ “ইচ্ছা” ও “ভ্রমণ”। এটি হল পবিত্র কাবা শরীফের আশেপাশে বিশেষ কিছু কাজ সম্পন্ন করা, যেমন তাওয়াফ ও সাঈ।
উমরাহ মুসলমানদের জন্য একটি বিশেষ ধর্মীয় কাজ, যা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রকাশের সুযোগ দেয়।
উমরাহর শুরু
মহান আল্লাহর নির্দেশে, কাবার নির্মাণের পর, হযরত ইবরাহীম (আঃ) এবং তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) উমরাহ পালনের নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠা করেন।
এই প্রক্রিয়াটি ইসলামি বিশ্বাসে একটি অতীত ঐতিহ্য হিসেবে চালু থাকে এবং মুসলমানদের জন্য তা পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উমরাহ পালন করার গুরুত্ব
আল্লাহর নির্দেশে উমরাহ পালন করা মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন –
وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ “তোমরা আমার জন্য হজ ও উমরাহ সম্পূর্ণরূপে পালন কর।” (সূরা বাকারা: ১৯৬)
আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন –
(عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ) – ”এক উমরাহ এর পর আর এক উমরাহ’র মধ্যবর্তী সময়ের (গুনাহ’র) জন্যে কাফফারা। হজে মাবরুরের প্রতিদান হলো জান্নাত।” (সহীহ বুখারীঃ ১৭৭৩)
উমরাহ পালন করার উপকারিতা
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন –
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ وَالذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَلَيْسَ لِلْحَجَّةِ الْمَبْرُورَةِ ثَوَابٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ ”
তোমরা নিয়মিত হজ ও উমরাহ পালন করতে থাকো। দরিদ্রতা ও গুনাহ দূর করে দেয় এই দুটি আমল। ঠিক যেমনভাবে উত্তপ্ত আগুন লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা-মরিচিকা দূর করে দেয়। জান্নাতই হলো একটি কবুল হজের উত্তম প্রতিদান। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। (সুনান আত তিরমিযীঃ ৮০৮)
এটি মুসলমানদের জন্য আধ্যাত্মিক উন্নতির একটি উৎস হিসেবে কাজ করে এবং তাদের জীবনে একটি নতুন আলো নিয়ে আসে।
রাসূল (সা.) এর উমরাহর সংখ্যা
কাতাদা (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন –
حَدَّثَنَا قَتَادَةُ، قَالَ قُلْتُ لأَنَسِ بْنِ مَالِكٍ كَمْ حَجَّ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم قَالَ حَجَّةٌ وَاحِدَةٌ وَاعْتَمَرَ أَرْبَعَ عُمَرٍ عُمْرَةٌ فِي ذِي الْقَعْدَةِ وَعُمْرَةُ الْحُدَيْبِيَةِ وَعُمْرَةٌ مَعَ حَجَّتِهِ وَعُمْرَةُ الْجِعِرَّانَةِ إِذْ قَسَّمَ غَنِيمَةَ حُنَيْنٍ .
আমি আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতবার হজ করেছেন? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার হজ এবং চারবার উমরাহ করেছেন।
তিনি উল্লেখ করলেন যে, একবার উমরাহ করেছিলেন যিলকাদ মাসে, একবার হুদায়বিয়ার উমরাহ, একটি হজ্জের সাথে উমরাহ এবং জি’ইররানা থেকে আরেকটি উমরাহ, যখন তিনি হুনায়ন যুদ্ধে অর্জিত সম্পদ বন্টন করেছিলেন। (সুনান আত-তিরমিজি: ৮১৪)
রাসূল (সা.) এর প্রথম উমরাহ
হিজরতের ষষ্ঠ বছরে, রাসূল (সা.) স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি সাহাবাদের সাথে মক্কায় উমরাহ পালন করছেন। এই সংবাদে সাহাবারা উমরাহের জন্য উৎসাহিত হন। তাই, রাসূল (সা.) ৪০০ সাহাবী নিয়ে জিলকদ মাসে উমরাহর উদ্দেশ্যে বের হন।
এ সময় মক্কার মুশরিকরা মুসলিমদের প্রতিরোধ করে। সংঘাত এড়াতে রাসূল (সা.) হুদাইবিয়াতে মুশরিকদের সাথে চুক্তি করেন। সেই চুক্তি অনুযায়ী, মুসলিমরা এবারের মত ফিরে যাবে এবং পরের বছরে তিন দিনের জন্য মক্কায় প্রবেশের অনুমতি পাবে। ফলে রাসূল (সা.) এবং সাহাবারা হুদাইবিয়াতেই ইহরাম ত্যাগ করেন। ফলে, এটি রাসূল (সা.) এর প্রথম উমরাহ হিসাবে বিবেচিত হয়।
উমরাহর বিধান
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে –
عَنْ جَابِرٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم سُئِلَ عَنِ الْعُمْرَةِ أَوَاجِبَةٌ هِيَ قَالَ “ لاَ وَأَنْ تَعْتَمِرُوا هُوَ أَفْضَلُ
একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উমরাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এটি কি বাধ্যতামূলক? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, না, তবে উমরাহ করলে ভালো। (সুনান আত-তিরমিজি: ৯৩৩)
এই হাদিস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য রয়েছে, তাদের জন্য উমরাহ পালন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। উমরাহ ইসলামের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক বিশেষ মাধ্যম। যে সকল মুসলমান এই ইবাদত পালনের সামর্থ্য রাখেন, তাদের উপর উমরাহ করা আবশ্যক নয়, তবে এটি করা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।
উমরাহর মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের গুনাহ মাফ করানোর পাশাপাশি, আল্লাহর কাছে আরো বেশি নৈকট্য অর্জন করতে পারেন। এজন্য উমরাহ পালন মুসলিম জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
উপসংহার
উমরাহ মুসলমানদের জন্য এক মহান ইবাদত, যা তাদের আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ দেয়। এর ইতিহাস এবং আল্লাহর নির্দেশের ভিত্তিতে উমরাহ পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য একটি পূণ্যের কাজ।
আল্লাহ্ আমাদের সকলকে নিশ্চিন্তে এবং নিরাপদে উমরাহ্ সফর করার তৌফিক দান করুন। বাইতুল্লাহকে চোখে দেখার সৌভাগ্য দিন।
আমীন।